ইসলাম

কুরআন তেলাওয়াতের বসন্তকাল

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

আমাদের দেশে বর্ষাকাল প্রধানত চাষাবাদের মওসুম। শীতকালে মাঠভরা রবিশষ্যের বাহার প্রাণ জুড়ায়। ঋতুরাজ বসন্তে নতুনের জয়গানে মুখরিত হয় প্রকৃতি। ঋতুচক্রের মতো পবিত্র রমজান মাসে যখন রহমতের জোয়ার বয়ে যায়, তখন শুরু হয় কুরআন তেলাওয়াতের বসন্তকাল।

পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। ঊর্ধ্বলোক থেকে পৃথিবীর বুকে কুরআনের অবতরণ শুরু হয় রমজানে কদরের রজনীতে। এ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র সূরা আছে কদরের রাতের ফজিলত ও মহিমা বর্ণনায়। এ কারণে নবী করিম (সা.)-এর যুগ থেকে রমজানে কুরআন তেলাওয়াতের বসন্ত সমীরণে প্লাবিত হয়েছে মুমিন বান্দার হৃদয়, ইসলামী সমাজ ও সভ্যতা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন,

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব সমাজে সবচেয়ে বেশি দানশীল। তবে রমজান মাসে যখন ফেরেশতা জিব্রাঈল তার সাথে সাক্ষাত করত তার দানশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। জিব্রাঈল রমজান মাসের প্রত্যেক রাতে তার সাথে সাক্ষাত করে তখন পরষ্পর কুরআন পাঠ করে শুনতেন ও শোনাতেন। তিনি আরো বলেন, জিব্রাঈল সাক্ষাত করলে নবী করিম (সা.)-এর দানশীলতা প্রবাহমান বাতাসের চাইতেও গতিশীল হয়ে যেত’। (আকাতরে তিনি দান-দক্ষিণা বিলাতেন।) বুখারী (৩২২০) মুসলিম (২৩০৪)

পাঠ্য বিষয় শোনা ও শোনানোর এই প্রক্রিয়ার নাম দাউর বা হাদিসের ভাষায় তাদারুস। এই তাদারুস থেকে মাদরাসা পরিভাষার উৎপত্তি। বস্তুত নবী করিম (সা.) এর জামানা থেকে রমজানে কুরআন তেলাওয়াতের এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজে রূহানী জাগরণ আনে। প্রতিটি মুসলমানের সংকল্প থাকে সারা বছর অবহেলায় কাটালেও অন্তত রমজানে একবার পুরো কুরআন খতম করব।

কিন্তু একটি সুচতুর মহল এই রূহানী জাগরণকে নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রচার করে, না বুঝে কুরআন মুখস্ত পড়া বা তেলাওয়াত অনর্থক। কুরআন মজীদ মানুষের হেদায়তের জন্য নাজিল হয়েছে। এই হেদায়াত লাভের জন্য কুরআন পড়তে হবে, অর্থ বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে। এটি সহজ কথা এবং এর জন্যই কুরআন নাজিল হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি কুরআন না বুঝে পড়ে তাতে কোনো সওয়াব হবে না, এমন কথা বলার অধিকার কারো নেই। হাদিস শরীফের দু’টি বর্ণনায় আমরা এখানে পেশ করতে চাই : হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত লিপিকার ফেরেশতাদের সাথে থাকবেন। আর যে কুরআন পড়ে ও তাতে আটকায়, তা তা করে এবং কুরআন তার পক্ষে কষ্টদায়ক হয় তার জন্য দু’টি পুরস্কার রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)

হাদিসের ভাষ্য থেকে পরিষ্কার, যারা কুরআন মজীদে পারদর্শী তারা আখেরাতে ফেরেশতাদের সাথে সম্মানিত অবস্থানে থাকবেন। কিন্তু যারা কুরআনে দক্ষ নয়, এমনকি পড়তে গিয়ে তা তা করে তাদের জন্যও সওয়াব রয়েছে। সেই সওয়াব আবার দ্বিগুণ। একটি সওয়াব তেলাওয়াতের। আরেকটি কুরআন তেলাওয়াতের জন্য কষ্ট করার কারণে লাভ করবে।

আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে আল্লাহর কিতাবের (কুরআনের) একটি অক্ষর পাঠ করল তার কারণে তার নেকি মিলবে। নেকি হলো আমলের (অর্থাৎ যা পাঠ করল তার) দশ গুণ। আমি বলছি না যে, আলিফ, লাম, মীম একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর। লাম একটি অক্ষর। এবং মীম একটি অক্ষর। (তিরমিজি ও দারেমীর বরাতে মিশকাত-২০৩৪)

সূরা বাকারার শুরুর তিনটি অক্ষর আলিফ, লাম, মীম । এগুলোকে বলা হয় হুরুফে মুকাত্তিআত, বিচ্ছিন্ন অক্ষর । এই অক্ষরগুলোর অর্থ আল্লাহ এবং রাসূল ছাড়া আর কেউ জানে না। সাহাবায়ে কেরামও এর অর্থ জানার চেষ্টা করেন নি। নবীজির এই উপমা প্রমাণ করে, অর্থ না বুঝে তেলাওয়াত করলেও প্রতিটি অক্ষরে কমপক্ষে দশটি করে নেকি পাওয়া যাবে। অন্যথায় তিনি হুরুফে মুকাত্তিআতের উপমা দিয়ে তেলাওয়াতের সওয়াব বুঝিয়ে দিতেন না।

এমন সওয়াব লাভের জন্য কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে মনের সবটুকু মমতা ঢেলে দিয়ে। পবিত্রতা অর্থাৎ অজু অবস্থায় বসে রেহাল বা উচু স্থানে কুরআনপাক রেখে ধীরে ধীরে অনুচ্চস্বরে পড়তে হবে। প্রত্যেক হরফ আরবি মাখরাজ অনুযায়ী উচ্চারণ করতে হবে। আয়াতের শেষে বা মাঝখানে ওয়াকফ বা থামার জায়গাগুলোতে যথা নিয়মে থামতে হবে। যদি অর্থ বুঝে আসে রহমতের আয়াতে খুশির ভাব প্রকাশ এবং আজাবের আলোচনায় আসলে ভয়ের জড়তা দেখাতে হবে। কেননা, কুরআন মজীদের তেলাওয়াতকালে আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হওয়া ও ভক্তিতে বিগলিত হওয়াকে ঈমানের চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘আল্লাহ অবর্তীণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব, যা সুসামঞ্জস্য এবং যা পুনঃপুন আবৃত্তি করা হয়। এর ফলে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গায়ের চামড়া শিউরে উঠে, অতঃপর তাদের চামড়া ও অন্তর বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটাই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি এর মাধ্যমে যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই’। (সূরা জুমার, ৩৯ : আয়াতÑ২৩)

সমকালীন মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক আল্লামা ইকবালের ছাত্র জীবনের একটি ঘটনা উপরোক্ত আয়াতের মর্ম অনুধাবনে আমাদের সাহায্য করবে। তিনি বলেন, আমি যখন সিয়ালকোটে পড়ালেখা করছিলাম, তখন ভোরবেলা উঠে প্রতিদিন কুরআনপাক তেলাওয়াত করতাম। মরহুম ওয়ালেদ সাহেব (পিতা) তার নিয়মিত দোয়া দরূদ হতে অবসর হয়ে আসতেন এবং আমাকে দেখে চলে যেতেন। একদিন ভোরে তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মুচকি হেসে বললেন।

‘কখনো সুযোগ হলে আমি তোমাকে একটি কথা বলব’।
কথাটি বলার জন্য আমি দু’তিনবার অনুরোধ জানালে তিনি বললেনÑ
‘যখন পরীক্ষা দিয়ে নেবে, তখন’।
যখন আমি পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম এবং লাহোর থেকে ঘরে আসলাম, তখন বললেন,
‘যখন পাশ করে ফেলবে’।

পাশ করার পর জিজ্ঞাসা করলাম। তখন বললেন যে,
(ঠিক আছে) বলব।
একদিন ভোরে যখন নিয়মমাফিক কুরআন তেলাওয়াত করছিলাম, তখন তিনি আমার কাছে আসলেন এবং বললেনÑ

‘বেটা বলছিলাম যে, তুমি যখন কুরআন পড় তখন এরূপ বুঝ যে, কুরআন তোমার ওপরই নাজিল হচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তোমার সাথে কথা বলছেন’।
ইকবাল বলছিলেন যে, তাঁর এই উক্তি আমার অন্তরের মধ্যে বসে যায়। আর তার স্বাদ অন্তরে এখনো পর্যন্ত অনুভব করছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button