
শামীমুল হক
‘ভোট দিছি ধানের শীষে, সাত্তার কেমনে পাস করলো?’ এ এক বিরাট প্রশ্ন। এ প্রশ্ন প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে উকিল আবদুস সাত্তার সম্পর্কে কিছু বলে নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা সংসদে যোগ দেবে না। শপথ নেবে না। কিন্তু নির্বাচনের পর জয়ী হওয়া ছয় সংসদ সদস্যকে দেখা গেল শপথ নিতে। এবং সংসদে যেতে। বিএনপি আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে তাদের দলীয় এমপিদের গ্রিন সিগন্যাল দিতে বাধ্য হন। এর পেছনেও কারণ ছিল। সে সময় উকিল আব্দুস সাত্তার সহ আরও দুই/একজন সংসদে যেতে একপায়ে খাঁড়া ছিলেন। দলীয় কোনো সিদ্ধান্তই তারা মানতে নারাজ। গোপনে তারা বৈঠকও করেন। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল দল সংসদে যোগ দিতে রাজি না হলে তারা নিজেরাই সংসদে যাবেন। দলের কথা শুনবেন না। অন্যদিকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়ে সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির শপথ নিয়ে নিয়েছেন তাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে। এতে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপি তাদের এমপিদের শপথ নেয়ার গ্রিন সিগন্যাল দিতে বাধ্য হয়। যদিও দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নেননি।
সে সময় উকিল আব্দুস সাত্তারের কাছে হার মানতে হয় দলকে। গত ১০ই ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ থেকে দলীয় এমপিদের পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও তিনি ছিলেন নারাজ। মানে উকিল আবদুস সাত্তার এতে রাজি ছিলেন না। তার কিছু করারও ছিল না। কারণ আগেই তার কাছ থেকে পদত্যাগের স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হয়। তাইতো দেখা যায় পরদিন দলের অন্যসব এমপিরা সংসদ ভবনে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিলেও তিনি সেখানে ছিলেন অনুপস্থিত। তার পদত্যাগপত্র আগেই সবার সঙ্গে ই-মেইলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখানে তিনি ব্যর্থ হন। তিনি যে সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেন তা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি- তা তার কথায়ই বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, সংসদ থেকে পদত্যাগ করা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। আর রাগে ক্ষোভে তিনি দল থেকেই পদত্যাগ করেন। এখানেই শেষ নয়, যে আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন, সে আসনে ফের এমপি হতে তিনি উপনির্বাচনে অংশ নেবেন। এ জন্য মনোনয়নপত্রও কিনেছেন। গতকাল বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে উকিল আবদুস সাত্তারের ছেলে মাঈনুল হাসান তুষার তার বাবার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
তার অর্থ তিনি আবারো এমপি হতে চান। তবে ধানের শীষ মার্কা নয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়বেন তিনি। হাতি, ঘোড়া যে মার্কাই পাক তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি তো জনপ্রিয় এলাকায়। দাঁড়ালেই পাস। এখানেই আসা যাক ‘ভোট দিছি ধানের শীষে, সাত্তার কেমনে পাস করলো’ প্রসঙ্গে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনের দুই তিনদিন পর গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। পাশ থেকে এক বৃদ্ধা ডাক দিলেন। দাঁড়াতেই কাছে এসে বললেন, বাবা একটা কথা কইতাম। কি বলবেন, বলেন চাচী? বাবা, একটা কথা কোনোভাবেই বুঝতে পারতাছি না। ভোট দিলাম ধানের শীষে, সাত্তার কেমনে পাস করলো? ও আচ্ছা বলে বুঝাতে লাগলাম। তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না। তার এক কথা- ভোট দিলাম ধানের শীষে, সাত্তার কেমনে পাস করলো? চাচীর এ কথাই প্রমাণ করে এখানে সাত্তার কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো মার্কা। ধানের শীষ মার্কা নিয়ে কে দাঁড়ালো সেটা বিষয় নয়।
বিষয় হলো অধিকাংশ ভোটার ধানের শীষে ভোট দেন। এ জন্যই তো ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ধানের শীষ মার্কা নিয়ে লড়াই করেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তিনি বিজয় লাভ করেন। এই আমিনীই ১৯৯৬ সালে এখানে নির্বাচন করে পেয়েছিলেন পাঁচ হাজারের কিছু বেশি ভোট। এখন প্রশ্ন হলো- সাত্তার সাহেব যে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন তিনি কি নিশ্চিত পাস করবেন? ধানের শীষ মার্কা ছাড়া অন্য মার্কা নিয়ে তিনি কতোটুকু যেতে পারবেন? উকিল আবদুস সাত্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের একাধিকবারের এমপি। আবার নির্বাচন না করেও হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। জীবন কাটিয়েছেন রাজার হালে। এমপি হয়েও তাকে এলাকায় কোনো উন্নয়ন কাজ করতে হয়নি। শুধুমাত্র ধানের শীষের কল্যাণে তিনি বার বার নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। একাধিকবার এমপি হয়েও তিনি দেখাতে পারবেন না তার হাত ধরে সরাইলের এ উন্নয়নটি হয়েছে। বরং প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি শাহজাদাপুর গ্রামে গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন এবার নির্বাচিত হলে আপনাদের রাস্তাটি করে দেবো। কিন্তু পাস করে আর তার খবর নেই। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও শাহজাদাপুর গ্রামে যাওয়ার রাস্তাটি আজও হয়নি।
ওই গ্রামের মানুষকে বহু কষ্ট করে, বর্ষায় কাদা পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো উকিল আবদুস সাত্তার সাহেবের বাড়িও অজপাড়াগাঁও পরমানন্দপুরে। এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু তার গ্রামে যাওয়ার রাস্তাটিও তিনি করতে পারেননি। তার গ্রামের রাস্তাটি করে দিয়েছেন ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা। কী লজ্জার কথা! উকিল আব্দুস সাত্তার এমনি এমনি হননি। ধানের শীষই তাকে সাত্তার বানিয়েছে। এই ধানের শীষই তাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এই ধানের শীষের জন্যই তিনি মন্ত্রিসভায় স্থান করে নিয়েছিলেন। এই ধানের শীষের জন্যই সাধারণ মানুষ তাকে বারবার ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি করলেন? শেষ পর্যন্ত ধানের শীষের সঙ্গেই চাতুরী করলেন। এখন উপনির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু কথা হলো- তার নির্বাচনী মাঠে লড়াই করার মতো শক্তি আছে কি? জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এমন উদাহরণ তৈরি করলেন যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। বিএনপি’র টিকিটে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি সংসদে যান। কিন্তু গত চার বছরে দুই বারের মতো কিছু সময়ের জন্য সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন। তাও জনতা দেখতে পেয়েছে তিনি কাঁপছিলেন।

এই কাঁপন কি বন্ধ হয়ে গেছে। লোভ ভর করে কাঁপনকে কি দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তার এই নাটকীয় সিদ্ধান্ত সরাইল বিএনপিকে আহত করেছে। কারণ এই সরাইল বিএনপি তার জন্য কতো কিছুই না করেছে। এলাকায় এলাকায় তার বিরুদ্ধে এখন মিছিল হচ্ছে। তাকে বেঈমান আখ্যা দিয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। বয়োবৃদ্ধ উকিল আবদুস সাত্তার শেষ জীবনে এসে বেঈমানের তকমা ললাটে লাগালেন! এখন কথা হলো- যে কারণে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। সে আশা কি পূরণ হবে তার? তিনি কি উপনির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন? উপনির্বাচনে এ আসনে ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টি প্রার্থী ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় নেতা রেজাউল করিমকে। কিন্তু মঙ্গলবার প্রার্থিতা পরিবর্তন করে মনোনয়ন দিয়েছে এডভোকেট আব্দুল হামিদকে। যিনি একেবারেই নতুন। সাবেক দুই বারের এমপি জিয়াউল হক মৃধাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তাহলে মৃধা কি বসে থাকবেন? নিশ্চয় না। তিনিও স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। এলাকায় ভদ্র ও ভালো মানুষ হিসেবে মৃধা বেশ পরিচিত। ওদিকে আওয়ামী লীগ এ আসনটি উন্মুক্ত ঘোষণা করেছে।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা মনোনয়নপত্র কিনেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তারের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা মঈন উদ্দিন মঈনও স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। এ ছাড়া স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের শীর্ষ নেতা অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজুও মাঠে রয়েছেন। তার পক্ষে শিক্ষকরা সোচ্চার। সব মিলিয়ে সরাইল ও আশুগঞ্জ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে লড়াই জমে উঠেছে। নির্বাচনে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা কি করবেন? তারা কি উকিল আবদুস সাত্তারকে ভোট দেবেন? মোটেও না। বরং উকিল আবদুস সাত্তারকে উচিত শিক্ষা দিতে তারা মাঠে কাজ করবেন। এক্ষেত্রে তারা যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। এটাই স্বাভাবিক। এমনটা হলে সাত্তার সাহেবের স্বপ্ন পূরণ হবে কি? কেউ কেউ বলছেন, এটা সরকারের চাল। সরকারই তাকে জিতিয়ে আনবেন সংসদে। সরকারের ইঙ্গিতেই তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন।
সরকারের ইঙ্গিতেই তিনি মনোনায়নপত্র কিনেছেন। এ কারণে তিনি জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকার কেন এটা করতে যাবে। এক সাত্তারকে নিয়ে সরকারের কি এমন লাভ হবে? এমনিতেই সরকারি দল আওয়ামী লীগে তার চেয়ে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা রয়েছেন সরাইল আশুগঞ্জে। সাত্তার সাহেবের মতো পোড় খাওয়া বিএনপি নেতা যিনি কিনা দলের সঙ্গে চাতুরি করেছে তাকে নিয়ে সরকার নিজের গায়ে কাঁদা লাগাবে কোন্ দুঃখে। আসলে এসব কিছুই না। উকিল আবদুস সাত্তার যা করছেন তার সবই অতি লোভের কারণে। তারপরও কথা থেকে যায়। আসনটি আওয়ামী লীগ উন্মুক্ত করে দেয়া, জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দুর্বল প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি।