ইতিহাস ঐতিহ্য

‘মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে’

মো. রেজাউল করিম চৌধুরী

১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী করে। কিন্তু পাকিস্তানিরা নির্বাচিত বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে দেয়। পরিষদ অধিবেশনের তারিখ দিয়েও বার বার পিছুতে থাকে তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার। ফলে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, আসে ৭১-এর ৭ই মার্চ। রমনার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু রাখেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধু মুলত: এই ভাষণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পাকিস্তানি সরকার আলোচনার কথা বলে গোপনে বাঙালি নিধনের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত ও নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নির্বিচারে গুলি করে গণহত্যা চালিয়ে, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে ও লুটপাট করে বিভীষিকাময় নারকীয় তাণ্ডবে মেতে ওঠে। ওই রাতেই অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে করাচিতে নিয়ে যায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। 

বাংলার ছাত্র, যুবক, তরুণ, কিশোর, কৃষক, শ্রমিক, জনতা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সাল হতেই আমি বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলমান সকল আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে থাকি। আমি ছিলাম সরকারি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। ৬৯ সালে আমি কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হই এবং ১৯৭০-৭১ সালে আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। মুক্তির নেশায় আমিও যুদ্ধে যাই। অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নিই। বিএলএফ এর ১নং সেক্টরের অধীনে চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ ও কোতোয়ালি এলাকায় গেরিলা অপারেশনে সরাসরি অংশ নিই। দিনে দিনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তি সেনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেশের সব স্থানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী গেরিলা আক্রমণ ও সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে বিপর্যস্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যৌথবাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে ১৬ই ডিসেম্বর পাক হানাদারেরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। অর্জিত হয় গৌরবময় বিজয়। বাঙালির এ গৌরবের বিজয়ের কাঁটা হয়ে ছিল এদেশীয় কিছু পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শাম্‌স। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী শান্তি কমিটি গঠন করে এবং রাজাকার, আল-বদর, আল- শাম্‌স বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের সহায়তা করে।

তারা কীভাবে আমাদের মা- বোনেদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল, আগুন লাগিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাট করেছিল, কীভাবে হাত-মুখ-চোখ বেঁধে স্বাধীনতার সপক্ষের লোকেদের ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে মেরেছিল-তা বর্তমান প্রজন্ম চিন্তাও করতে পারবে না। আমরা বিজয় দেখেছি, বিজয় এনেছি। আমরা দেখেছি সন্তান হারা মা ও সম্ভ্রম হারা বোনের আর্তনাদ, লাশের স্তূপ। একাত্তরে যারা পাকিস্তানিদে দোসর হয়ে বাঙালির ওপর এমন বীভৎসতা চালিয়েছিল তারা পরাজিত হলেও, পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে বাঙালিকে মেধাশূন্য করে দিতে ১০ থেকে ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তানের কারাগারে হত্যা করতে না পেরে স্বাধীনতার পর নতুন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাজিত শত্রুরা ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।  ৪ঠা নভেম্বর কারাগারের ভেতরে জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালায়।

স্বাধীনতার শত্রুরা এখনো সাম্প্রদায়িকতা মোড়কে থেকে অদম্য বাংলাদেশকে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নতুন প্রজন্মকে ধর্মের অপব্যবহার করে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে। আমাদেরকে তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, আমাদের সন্তানেরা যাতে কোনো দেশবিরোধী চক্রের খপ্পরে না পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শক্তিকে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তাহলেই যে সোনার বাংলার স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ লড়াই করে এদেশের স্বাধীনতা এনেছিলাম- সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। এই দেশ হবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক: মেয়র, চসিক ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button