
আতঙ্কের কিশোর গ্যাং ‘ভাইব্বা ল কিং’
অনলাইন ডেস্ক:
চক্রের সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের ভেতরে। পারিবারিক অবস্থা নিম্নবিত্ত। লেখাপড়া সর্বোচ্চ দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। অভাবের তাড়নায় কেউ ছিল অটোরিকশা চালক। কেউ মুদির দোকানের কর্মচারী। আবার কেউ কেউ নির্মাণ শ্রমিক ও অফিসের পিয়ন। এসব পরিচয়ের আড়ালে ভয়ঙ্কর পরিচয় রয়েছে তাদের।
তারা সবাই মিলে গড়ে তুলেছে কিশোর গ্যাং। যেনতেন গ্যাং নয়। ‘ভাইব্বা ল কিং’ নামের এই গ্যাং সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতো। ভাড়ায় খাটা থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, আধিপত্য বিস্তারে নেতাদের সহযোগিতাসহ নানা কাজে লিপ্ত ছিল। দিনদুপুরে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতো। প্রতিপক্ষ গ্রুপকে হামলা করতো। তাদের দাপটে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত থাকতো। অস্ত্রের বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে টিকটক ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে ছাড়তো।
র্যাব জানায়, গত ২/৩ বছর ধরে রাজধানী মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, বসিলা ও রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র মহড়া, ভাড়ায় শোডাউন করে আসছে এই গ্যাংটি। গত সোমবার রাতে এক দম্পতি এই গ্যাংয়ের সদস্যদের দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়। পরে ওই দম্পতি র্যাব-২ কন্ট্রোল রুমে অভিযোগ করার ১০ মিনিটের মধ্যে চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। বাকিরা হলো- মো. রুমান (১৮), গ্যাং লিডার শরীফ ওরফে মোহন (১৮), মো. উদয় (১৯), মো. শাকিল (১৯), মো. নয়ন (১৮) ও মো. জাহিদ (১৮)। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৪টি লোহার দেশীয় তৈরি ছুরি, ১টি স্টিলের হাতলযুক্ত কুঠার, গাঁজা ৫০ পুরিয়া, ২টি স্টিলের তৈরি ছুরি, ১টি স্টিলের তৈরি হোল্ডিং চাকু, ১টি প্লাস্টিকের পিস্তল, ৬৫ পিস ইয়াবা ও ইয়াবা খাওয়ার সরঞ্জামাদি এবং ৩টি মোবাইল ফোন।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর বেশকিছু এলাকাকে ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হটস্পট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও বসিলা ও রায়েরবাজার এলাকা অন্যতম। এসব এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য পায় র?্যাব। সোমবার রাত ৯টায় ঢাকা উদ্যানের সামনে থেকে র্যাব-২ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে ছিনতাইয়ের খপ্পরে পড়ার তথ্য জানিয়ে সহযোগিতা চায় এক দম্পতি। র্যাব-২ এর গোয়েন্দা ও টহল দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এরপর রায়েরবাজার এলাকা থেকে ছিনতাইয়ে জড়িত চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ছিনতাই করা ভ্যানিটি ব্যাগ। রাতেই র?্যাবের টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করে চাঁদ উদ্যান সংলগ্ন সাত মসজিদ হাউজিং এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং চক্রটির লিডার মোহনসহ আরও ৫ সদস্যকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র পিস্তল সদৃশ ও মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা ‘ভাইব্বা ল কিং’ নামক একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপের সদস্য। চক্রের সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। দলের লিডার মোহনের নেতৃত্বে ২/৩ বছর আগে গ্যাংটি গঠন করা হয়। এরা মোহন সিন্ডিকেট নামেও পরিচিত। এই গ্রুপের সদস্যরা পূর্বে লেবেল হাই গ্যাং-এ কাজ করতো। আন্তঃকোন্দলের জন্য পরে লেবেল হাই গ্রুপটি ৫/৬টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। ওই গ্রুপ থেকে বের হয়ে মোহন ‘ভাইব্বা ল কিং’ গ্রুপটি তৈরি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের গ্যাং সংক্রান্ত বিভিন্ন ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রচারণা পাওয়া যায় যেমন ‘মোহাম্মদপুরের পোলাপান যা করি তা টোকেন ছাড়াই ওপেন’, ‘মোহাম্মদপুরের পোলা বাজান, আমি একাই একশ’, গেঞ্জাম করার আগে ভাইব্বা লইও’।
খন্দকার মঈন বলেন, কিশোর গ্যাং চক্রটি মোহাম্মদপুর এলাকায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চুরি-ডাকাতি আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। তারা ভাড়ায় বিভিন্ন স্থানে হুমকি ও মারপিটে অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। অপরাধ কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নিজেদের কিং হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। তারা লেগুনা, অটোচালক, দোকানের কর্মচারী, নির্মাণকর্মী ও অফিসের বার্তাবাহক পেশার পাশাপাশি মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। তারা বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ব্যাংকের আশপাশে অবস্থান নিয়ে গ্রাহকদের টার্গেট করতো। র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাইব্বা ল কিং’ গ্রুপটিতে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে পেছন থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্ত করা হয়েছে। চক্রে জড়িত পলাতক সদস্যসহ তাদের পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এই গ্যাংটির বিষয়ে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রগুলো বলছে, মোহাম্মদপুর এলাকা ঘিরে একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা থাকলেও ভাইব্বা ল কিং গ্রুপের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। সংখ্যায় কম হলেও এই গ্রুপের সদস্যদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে গ্রুপের মূল হোতা মোহনের নেতৃত্বে গ্রুপটি পরিচালিত হয়। তাদেরকে মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকজন নেতা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পারিবারিক অবস্থা ভালো না হলেও গ্রুপের সদস্যরা সারাক্ষণ ফ্যান্টাসির মধ্যে থাকতো। ভালো হোটেলে খাবার থেকে শুরু করে নেশার জগতে বুঁদ হয়ে থাকতো। তাদের এসব অর্থের জোগান আসতো চাঁদাবাজি ও ছিনতাই থেকে। দিনে ছিনতাই কম করলেও রাতে তারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ছিনতাই করতো। রাত গভীর হলেও মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, বছিলা ও রায়েরবাজারসহ আশেপাশের এলাকায় অস্ত্র নিয়ে ছিনতাইয়ে নামতো। পথচারী থেকে শুরু করে রিকশা, সিএনজি ও প্রাইভেটকারের যাত্রীদের থামিয়ে তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সব ছিনিয়ে নিয়ে যেত। ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তারা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতো। পাশাপাশি তারা ছোট ছোট ব্যবসায়ী, হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করতো।
সূত্রগুলো বলছে, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, বছিলা ও রায়েরবাজার এলাকায় মাদক বিক্রি করতো তারা। আধিপত্য বিস্তারে তারা অস্ত্রের মহড়াসহ নানারকম হুমকি-ধমকি দিতো। প্রকাশ্য এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বিভিন্ন মানুষ ও তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপকে থ্রেট করতো। নানারকম অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কথা বলতে পারতো না। এলাকায় রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং হলে তাদেরকে ভাড়া করে নেয়া হতো। টাকার বিনিময়ে তারা জমি দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মারামারিতে অংশগ্রহণ করতো। এত সব অপরাধ করার পরও একমাত্র মোহন ছাড়া পুলিশের খাতায় আর কারও নাম নেই।